অভিযোগ রয়েছে,নিম্নমানের বাতি লাগানোর কারণে নগরীর প্রধান সড়কগুলোতে রাতের বেলায় মিলছে না পর্যাপ্ত আলো। এতে ৫০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা দুই দফায় চিঠি দিয়ে এসব বাতি অপসারণের নির্দেশ দিলেও এর তোয়াক্কা করছে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।বরং সড়কে লাগানো নিম্নমানের এসব বাতিকে জায়েজ করতে প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।
জানা গেছে,শুরুতে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সড়কে বিশ্বমানের ৩৬ ওয়াটের বাতি লাগানোর জন্য বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ দিয়েছিলেন।তবে সে সুপারিশ অমান্য করে সিটি মেয়র একক সিদ্ধান্তে ৩৬ ওয়াটের সঙ্গে ৬০ ওয়াটও যুক্ত করে টেন্ডার আহ্বান এবং কার্যাদেশ দেন।তার এমন কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।এ সিটির সড়কে বাতি স্থাপনের জন্য টেন্ডার আহ্বানের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৯ সালে।টেন্ডার আহ্বানের আগেই একটি বিশেষ মহল তাদের পছন্দের নিম্নমানের বাতি কেনার জন্য বিভিন্ন ধরনের তদবির শুরু করে।
সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে,এ প্রকল্পের আওতায় ৪৯ কোটি টাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রকল্পের প্রাক্কলন তৈরি করা হয়।ওই নোট শিটে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন,তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন ও সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান স্বাক্ষর করেন। কিন্তু ৩৬ ওয়াটের সঙ্গে ৬০ ওয়াটের বাতি সংযুক্ত করার জন্য একটি মহল উঠে পড়ে লাগে।টেন্ডার আহ্বানেও ৬০ ওয়াটের বাতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার কাজী শাহ আলম মেয়রের কাছে একটি চিঠি দেন।এতে তিনি অভিযোগ করেন, প্রকল্পের প্রস্তাবনায় ৩৬ ওয়াটের এলইডি বাতি কেনার কথা উল্লেখ থাকলেও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ এর পরিবর্তে ৩৬/৬০ ওয়াটের বাতি অন্তর্ভুক্ত করে টেন্ডার আহ্বান করেছে। একই বছরের ৮ জানুয়ারি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ৩৬ ও ৬০ ওয়াটের বাতি টেন্ডার শিডিউলে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী টেন্ডার সংশোধন করে পুনরায় আহ্বানের সুপারিশ করেন।
ওই সূত্র আরও বলছে,সিটি মেয়র নিজে বিশেষজ্ঞ না হওয়া সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞ সে সুপারিশ অবজ্ঞা করে তিনি একক সিদ্ধান্তে ৩৬ ওয়াটের পরিবর্তে ৩৬ ও ৬০ ওয়াট বাতি লিখে টেন্ডার সংশোধনের এককভাবে নির্দেশ দেন।এভাবেই টেন্ডার আহ্বানের পূর্বেই পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার একটি অবৈধ প্রক্রিয়া চালানো হয়।
এদিকে,এডেক্স করপোরেশন নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ১ থেকে ৫ ও ৭, ৮ নম্বর প্যাকেজের কাজটির কার্যাদেশ দেওয়া হয়।একটি প্রতিষ্ঠানকে সাতটি প্যাকেজের কাজ দেওয়া নিয়েও বিভিন্ন মহলে আলোচনা ওঠে।তবে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী জার্মান অথবা ফ্রান্সের তৈরি এলইডি বাতি সরবরাহ না করে চীনের তৈরি নিম্নমানের বাতি স্থাপন করে।যেখানে জার্মানির তৈরি এলইডি বাতির মূল্য ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা।আর চীনা তৈরি বাতির মূল্য মাত্র এক হাজার টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল এক প্রকৌশলী জানান,এ বিষয়ে বিভিন্ন মহলের আপত্তির মুখে সরবরাহ করা বাতি পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে(বুয়েটে)পাঠানো হয়।বাতিগুলো জার্মানির তৈরি নয়, চীনের তৈরি এবং নিম্নমানের বলে বুয়েট থেকে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
এরপর ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এডেক্সকে চিঠি দেন।এতে উল্লেখ করেন সিটির সড়কে লাগানো এলইডি বাতিতে ব্রান্ড,ভোল্টেজ,রেঞ্জ,ওয়াট,উৎপাদন কোন দেশে,লুমান,লাইফ টাইম সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই।তাছাড়া বাতির গায়ে দেখা যায়,এগুলো চীনের তৈরি।এতে স্পষ্ট বোঝা যায়,সিটিতে স্থাপন করা বাতি ফ্রান্স বা জার্মানির তৈরি নয়।সে কারণে সাত দিনের মধ্যে সব বাতি অপসারণের নির্দেশ দেন মেয়র।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার জুবায়ের বিন রহমান স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বলা হয়,সরবরাহ করা বাতির ভেতরে‘চীনের তৈরি লেখাটি’পুনরায় প্রতিস্থাপন করা হবে।কিন্তু গত ১০ জানুয়ারি সিটি মেয়র ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় বলে আরেকটি চিঠি দেন।এতেও তিনি সাত দিনের মধ্যে সব বাতি অপসারণের নির্দেশ দেন।এ নির্দেশের পর ১০ দিন অতিবাহিত হলেও কোনও বাতি অপসারণ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
সার্বিক বিষয়ে জানতে সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তিনি কথা বলতে অপারগতা দেখান।তবে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক এমদাদ হোসেনের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন,‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা বাতি নিম্নমানের এবং শিডিউল বহির্ভূত। সে কারণে বাতি অপসারণ করতে বলা হয়েছে।আমরা দুই দফায় চিঠি দেওয়ার পরও কোনও পদক্ষেপ নেয়নি তারা। তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।