অনলাইন ডেস্ক:- ১৯অক্টোবর ১৯৭৩।সকাল ৯টা।আজকের শারদ স্নিগ্ধ সকালটিতে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অন্য ধরনের আমেজ।সকাল থেকেই ঢাকা সেনানিবাস থেকে মিলিটারি জিপগুলো ছুটছে বিমানবন্দরের দিকে।কমবেট কালারের একটি জিপ থেকে বিমানবন্দরের টার্মিনালে নামলেন খাকি ইউনিফর্ম পরা দীর্ঘাঙ্গি কর্নেল খুরশীদ উদ্দিন আহমেদ।মধ্য তিরিশের এই মুক্তিযোদ্ধা কর্নেলের নেতৃত্বেই দুই ঘণ্টা পর আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে(১৯৭৩)আরবদের সহায়তার জন্য একটি মেডিকেল টিম সিরিয়ার উদ্দেশে রওনা হচ্ছে।উল্লেখ্য,প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ উদ্যোগে মেডিকেল টিমকে সিরিয়া পাঠানো হচ্ছে।বিমানবন্দরে সিরিয়াগামী সেনাদলকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানাতে সমবেত হয়েছে হাজারো মানুষ।এয়ারপোর্টে ইতোমধ্যে উপস্থিত হয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান,উপ-সেনাপ্রধান,চিফ অব স্টাফ ও ডাইরেক্টর জেনারেল অব মেডিকেল সার্ভিসেসসহ সিনিয়র সেনা কর্মকর্তারা।১৯৭১-এর রণাঙ্গন কাঁপানো এই বাঙালি সেনানায়করা আরেকটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইলেন,শরতের এই রোদভরা সকালে।৭অক্টোবর ১৯৭৩।মিসরে স্থানীয় সময় এখন দুপুর ১২টা।রেডিও কায়রোয় অনেকক্ষণ ধরে উদ্দীপনামূলক দেশাত্মবোধক গান বেজে চলেছে।আরবি গান শেষে একজন বেতার ঘোষক বললেন,এতক্ষণ দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করলেন শিল্পী উম্মে কুলসুম।এখন শুনবেন রণাঙ্গনের সর্বশেষ সংবাদ।সুয়েজ খাল অতিক্রম করে মিসরীয় বাহিনী,ইসরায়েলি বাহিনীর প্রতিরোধ ব্যবস্থা বারলেভ লাইন ধ্বংস করে সিনাই ফ্রন্টে দ্রুত এগিয়ে চলেছে।সিরিয়ার গোলান ফ্রন্টেও অবৈধ দখলদারি ইসরায়েলি বাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে।এদিকে যুদ্ধরত আরবদের প্রতি সমর্থন ও সংহতি জানিয়ে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে বিশেষ বার্তা পাঠিয়েছেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।এখন শুনবেন পবিত্র কোরআনের বাণী।ইসরায়েল অধিকৃত ভূমি উদ্ধারের জন্য ১৯৭৩সালে মিসর ও সিরিয়া যৌথভাবে ৬অক্টোবর ১৯৭৩তারিখে ইসরায়েল আক্রমণ করে,যা ইতিহাসে‘আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ অক্টোবর ১৯৭৩নামে খ্যাত। আরবদের ন্যায়সংগত এই যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু-সরকার সিরিয়ার রণাঙ্গনে একটি সেনা মেডিকেল টিম ও মিসর সেনাবাহিনীর জন্য চা পাঠিয়েছিল।এটিই ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম বৈদেশিক দায়িত্ব।বাংলাদেশ সরকারের সেই সিদ্ধান্তটি ছিল ঐতিহাসিক,সাহসী,সুদূরপ্রসারী ও কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অধিকাংশ আরব দেশ তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কমবেশি সব আরব দেশগুলোতে প্রচারণা চলছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।এ সময় এক বিস্ময়কর কূটনৈতিক অভিযানে অবতীর্ণ হলেন বঙ্গবন্ধু।ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরবদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে ঘোষণা করলেন‘আরবরা আমাদের স্বীকৃতি দিক না দিক,তারা আমাদের ভাই।তাদের ন্যায্য সংগ্রামে আমরা তাদের পাশে আছি।এই পটভূমিতেই সিরিয়ার রণাঙ্গনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি মেডিকেল টিম পাঠানো হয়েছিল।কর্নেল খুরশীদ উদ্দিন আহমেদের(পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার,প্রয়াত)নেতৃত্বে ২৮সদস্যের একটি মেডিকেল টিম ১৯৭৩-এর ১৯অক্টোবর সিরিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়।আর্মি মেডিকেল কোরের সাতজন ডাক্তার ও ২১জন প্যারামেডিক,মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়ে এই দল গঠিত হয়েছিল।মেজর আমির আলি ছিলেন এই দলের ডেপুটি টিম লিডার ও সার্জিক্যাল টিমের প্রধান।পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরুণ ও চৌকশ কূটনীতিক মোহাম্মদ জমির(পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূত)কূটনৈতিক যোগাযোগ ও সমন্বয়ের জন্য লিবিয়া পর্যন্ত গিয়েছিলেন।মেডিকেল টিমের সঙ্গে আরও গিয়েছিলেন সাংবাদিক হাবিবুল্লাহ ও ক্যামেরাম্যান রফিক উদ্দিন আহমেদ।উল্লেখ্য,১৭অক্টোবর বিকালে,বঙ্গবন্ধু বেইলি রোডের(পুরাতন)গণভবনে মেডিকেল টিমের সদস্যদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।বঙ্গবন্ধু তাদের উদ্দেশে পাঁচ-ছয় মিনিটের উদ্দীপনামূলক বক্তব্য রাখেন।জাতির পিতার কথায় সেনাসদস্যরা অনুপ্রাণিত ও অভিভূত হন।
সৈন্যবাহী বিমানটির যাত্রা বিরতি হলো বাহরাইনে।এরপর বিমানটি তুরস্ক-গ্রিস মাল্টার আকাশ হয়ে অবশেষে সন্ধ্যায় ল্যান্ড করল লিবিয়ার বেনগাজি বিমানবন্দরে।বেনগাজিতে মিসরের প্রতিনিধির কাছে মিসরীয় বাহিনীর জন্য বাংলাদেশের চায়ের প্যাকেটগুলো হস্তান্তর করা হলো।২১অক্টোবর,লিবিয়া সরকারের বন্দোবস্তে বাংলাদেশের সেনাদল মিডল ইস্ট এয়ারলাইনসের একটি বিমানে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে পৌঁছে।বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত(প্রখ্যাত সাংবাদিক) কেজি মোস্তফা ও সিরিয়া সরকারের প্রতিনিধিরা।বৈরুত থেকে রাতের বেলায় সড়কপথে সিরিয়ার রাজধানীর দিকে সেনাদলটি এগিয়ে চলে।অবশেষে ২২অক্টোবর ভোররাতে দামেস্ক নগরীতে পৌঁছাল মেডিকেল টিম।এর কিছুক্ষণ পরই দামেস্ক নগরী ভয়াবহ ইসরায়েলি বিমান আক্রমণে কেঁপে ওঠে।এদিকে,যুদ্ধের প্রথম দিকে সিরিয়া ও মিসর অসামান্য সাফল্য অর্জন করলেও পরবর্তীতে যুদ্ধের মোড় ইসরায়েলের পক্ষে চলে যায়।ইসরায়েলি বাহিনী দামেস্ক নগরীর ২৫মাইলের মধ্যে চলে আসে।বাংলাদেশের মেডিকেল টিমটি দামেস্ক নগরীর পশ্চিমদিকে দারেস সালাম নামক স্থানে মোতায়েন করা হয়।সেখানে মেয়েদের একটি স্কুলে ইতোপূর্বে সিরিয়ার চিকিৎসকরা একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।ওই চিকিৎসা কেন্দ্রটিকে বাংলার মেডিকেল দল একটি ক্ষুদ্র তবে কার্যকর ফিল্ড হাসপাতালে পরিণত করে।ওই হাসপাতালে মূলত সিরিয়ার আধাসরকারি বাহিনী ও প্যালেস্টাইনি যোদ্ধাদের চিকিৎসা করা হতো।
★প্রকাশক:- মোঃ মোশারফ হোসেন তোকদার।
★ব্যবস্থাপনা পরিচালক:- মোঃ এম,খোরশেদ আলম,সভাপতি প্রেসক্লাব পীরগাছা,রংপুর বিভাগ।
© All rights Reserved © 2020 গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয়ের বিধি মোতাবেক নিবন্ধনের জন্য আবেদিত এই ওয়েবসাইটি Tokdernews.com বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পোর্টাল।