দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। শুধু শহর বা প্রত্যন্ত অঞ্চলই নয়, অতিবৃষ্টি ও উঁচু অঞ্চল থেকে পানি এলে রাজধানী ঢাকাও প্লাবিত হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম।সর্বশেষ পাওয়া তথ্যানুযায়ী, উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি ও বন্যায় দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে এ পর্যন্ত ১২ জেলার ৬৪ উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা। বন্যায় সিলেটের ৬০ শতাংশ প্লাবিত হয়েছে। আর সুনামগঞ্জের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পানিতে ডুবে গেছে। এসব অঞ্চলে সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, স্থানীয় প্রশাসন ছাড়াও বিভিন্ন মহল উদ্ধার এবং অন্যান্য সহায়তামূলক কাজ করছে।
এদিকে গতকাল থেকে সিলেটের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক করা সম্ভব হলেও সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এবং আবহাওয়া অধিদফতর থেকে বলা হয়েছে, উজান ও ভাটিতে পাল্লা দিয়ে নামা বৃষ্টির কারণে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। আগামী ১২ ঘণ্টায় এ বিভাগের বেশির ভাগ জেলায় পানি আরও বাড়তে পারে। তবে কাল মঙ্গলবার থেকে বৃষ্টি কমে বন্যার পানি কমতে পারে। সূত্র জানায়, উত্তরের জনপদ কুড়িগ্রাম দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের পানি দ্রুত বাড়ছে। এর প্রভাবে ভাটি এলাকা গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। আগামী কয়েক দিন সেখানে পানি আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশের উজানের আরেক নদী গঙ্গা অববাহিকায় ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ফলে সেখানে পানি বেড়ে তা আগামী ১২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের মধ্যাঞ্চলে প্রবেশ করতে পারে।নদী ও পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি একযোগে বাড়লে দেশে মাঝারি থেকে বড় বন্যা হয়ে থাকে। কারণ, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানি বাড়লে তা চার থেকে সাত দিনের মধ্যে পদ্মা হয়ে বঙ্গোপসাগরে নেমে যায়। কিন্তু গঙ্গার পানি একই সময়ে বাড়লে তা ব্রহ্মপুত্রের পানির চাপে দেশের উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত পানি আটকে থাকে। ফলে পানি ১০ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ বছর এ ধরনের বন্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, ব্রহ্মপুত্রের পানি এরই মধ্যে বেড়ে গেছে, গঙ্গার পানি দ্রুত বাড়ছে। অন্যদিকে সিলেটে বন্যার পানি এখনো বাড়ছে।বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, উজানে ভারী বৃষ্টির কারণে দেশের সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। এর ফলে নতুন করে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনাসহ লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। নতুন করে প্লাবিত হতে পারে টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলার নিম্নাঞ্চল। দেশের প্রধান নদ-নদীগুলোর সবকটিতেই পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে ৯টি নদীর ১৮ পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে।বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে গতকাল আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-সিলেট : প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সিলেটে চলছে টানা বর্ষণ। অতিবৃষ্টিতে ধস শুরু হয়েছে পাহাড় ও টিলায়। সিলেট নগরীর টিলাগড়স্থ ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের ঐতিহাসিক থ্যাকারের টিলায়ও ধস শুরু হয়েছে। গত শনিবার থেকে টিলার মাটি ধসে পড়া শুরু হয়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে এমসি কলেজের অধ্যক্ষের শতবর্ষের পুরনো বাংলোটি। গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, বাঁশ পুঁতে টিলাধস ঠেকানোর চেষ্টা করছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলের বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। বাসাইল উপজেলার বাসাইল দক্ষিণ পাড়া-বালিনা সড়কের একটি অংশ পানির তীব্র স্রোতে ভেঙে গেছে। ফলে বন্যার পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। গতকাল জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সকালে যমুনা নদীর পানি টাঙ্গাইল সদর উপজেলার পোড়াবাড়ী পয়েন্টে ৩০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ঝিনাই নদীর পানি জোকারচর পয়েন্টে ১৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ ছাড়াও ধলেশ্বরী নদীর পানি এলাসিন পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে নদীভাঙন অব্যাহত আছে।কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। গতকাল বিকাল ৩টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৩৮ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে ৩১ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তবে তিস্তা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে ২৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছিল।কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, নাগেশ্বরীতে বেড়িবঁাঁধের ৫০ মিটার ওয়াশ আউট হয়ে গেছে। এ ছাড়া দুধকুমার নদের কালিগঞ্জ, বামনডাঙ্গা ও ধাউরারকুটি এলাকায় বাঁধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।জামালপুর : টানা বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ শাখা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত যমুনার পানি বেড়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জামালপুরে যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, জিঞ্জিরামসহ শাখা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ১২ সেন্টিমিটার বেড়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলী, সাপধরী, নোয়ারপাড়া, বেলগাছা, দেওয়ানগঞ্জের চিকাজানী ও চুকাইবাড়ি এবং বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ও মেরুরচর ইউনিয়নে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়। এসব এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি, ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় বন্যা প্লাবিত ৩২৬টি পরিবার রেলওয়ে স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে। জামালপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানিয়েছেন, পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়নি। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে।পাবনা : পাবনার পদ্মা-যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি শুরু করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উত্তরাঞ্চলীয় পরিমাপ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদ হোসেন জানান, ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীস্থ পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে দুপুর ১২টায় পানির উচ্চতা রেকর্ড করা হয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার। যুমনা নদীর নগরবাড়ি পয়েন্টে ৯ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার অতিক্রম করেছে। প্রায় প্রতিদিনই পদ্মা ও যমুনার বিভিন্ন পয়েন্টে ১/২ সেন্টিমিটার করে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে আজমিরীগঞ্জ ও নবীগঞ্জে কয়েক হাজার পরিবার বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (অ.দা.) মিনহাজ আহমেদ শোভন জানান, কুশিয়ারার পানি অব্যাহতভাবে বাড়ছে। নদীর বাঁধ উপচে পানি হাওরে প্রবেশ করার ফলে নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। দিঘলবাগ, ইনাতগঞ্জ, বড় ভাকৈর, আউশকান্দি ইউনিয়নের গ্রামগুলো প্লাবিত হচ্ছে।জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে নবীগঞ্জের পাশাপাশি আজমিরীগঞ্জ উপজেলায়ও অনেক গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ২ হাজারেরও বেশি মানুষ অবস্থান নিয়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, টানা বর্ষণ, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার কুশিয়ারা, কালনীসহ বিভিন্ন নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কুশিয়ারার পানি আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কৈয়ার ঢালাসহ কয়েকটি পয়েন্ট এবং নবীগঞ্জ উপজেলার কুশিয়ারা ডাইকসহ কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে হাওরে পানি প্রবেশ করছে। অর্ধশতাধিক গ্রাম এরই মধ্যে প্লাবিত হয়েছে।হবিগঞ্জে ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মাঝে রয়েছে আউশ ধান, বোনা আমন ধান ও সবজি। আক্রান্ত হয়েছে নবীগঞ্জ, লাখাই, বানিয়াচং ও সদর উপজেলায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (উদ্যান) নয়ন মনি সূত্রধর জানান, পানিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে নবীগঞ্জ ও লাখাই উপজেলা।গলাচিপা (পটুয়াখালী) : গলাচিপায় জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে রামনাবাদ নদীর ওপর গলাচিপা-হরিদেবপুর ফেরির গ্যাংওয়ে। ফলে নদীর দুই পাড়ে আটকে আছে অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস, পণ্যবাহী গাড়িসহ অর্ধশতাধিক বিভিন্ন যানবাহন। উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণে দিনে দুবার জোয়ারের পানিতে ডুবে যাচ্ছে নদীসংলগ্ন এলাকাগুলো। গৃহবন্দি হয়ে পড়ছে এসব অঞ্চলের মানুষ।বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গলাচিপা খেয়াঘাট, গলাচিপা-হরিদেবপুর ফেরিঘাট, পানপট্টি লঞ্চঘাট, বদনাতলী লঞ্চঘাটসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থান জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। গলাচিপা-হরিদেবপুর ফেরিঘাটে রামনাবাদ নদীর দুই পাড়ে জোয়ারের সময় যানবাহন ফেরিতে উঠতে পারছে না। ফলে দূরবর্তী স্থান থেকে ট্রাকে করে আনা কাঁচামাল পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।বরিশাল : বরিশালে চলতি মৌসুমে এক দিনে সর্বোচ্চ ৭৯.৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে স্থানীয় আবহাওয়া বিভাগ। অন্তত আরও তিন দিন মাঝারি থেকে ভারী এবং বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে তারা। এদিকে ভারী বর্ষণ, পূর্ণিমার জো এবং উত্তরাঞ্চলের বন্যার প্রভাবে বরিশাল বিভাগের দুটি নদীর পানি জোয়ারের সময় বিপৎসীমা অতিক্রম করছে। আরও কয়েকটি নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানির চাপ বেশি হওয়ায় ওইসব এলাকার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে।বগুড়া : যমুনার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় সারিয়াকান্দি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করা ৬ হাজার ১২০টি পরিবার এখন বন্যাকবলিত। এসব পরিবারে ২ হাজার ২৩০টি বাড়িঘর পানিতে সম্পূর্ণ এবং ৫৫০টি পরিবার আংশিকভাবে নিমজ্জিত রয়েছে। বন্যার পানি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে উপজেলার ৯৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পানিতে তলিয়ে গেছে ২০ হাজার টিউবওয়েল। পানিবন্দি হয়েছে ১৫ হাজার গবাদি পশু। বন্যাকবলিত এসব এলাকার ৫০০ পরিবারের লোকজন এখন আশ্রয় নিয়েছেন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি আর ২ থেকে ৩ দিন অব্যাহত থাকতে পারে। এক্ষেত্রে মাঝারি আকারের বন্যা হবে। সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে বাঙ্গালী নদীর পানি বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।মানিকগঞ্জ : কয়েক দিন ধরেই মানিকগঞ্জের পদ্মা-যমুনায় পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে নদীতে প্রবল স্রোতের সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে ব্যাহত হচ্ছে আরিচা-কাজিরহাট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের ফেরি চলাচল। ২৪ ঘণ্টায় যমুনায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগের ২৪ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল ৩৫ সেন্টিমিটার। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্রোতের বিপরীতে ফেরি চলতে সময় বেশি লাগার কারণে যানবাহন সময়মতো পারাপার হতে পারছে না। গতকাল সকালে আরিচা-কাজিরহাট ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের ঘাট এলাকায় পারের অপেক্ষায় ট্রাকের লম্বা লাইন ছিল। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েন যানবাহনের চালক ও শ্রমিকরা। বিআইডব্লিটিসি আরিচা আঞ্চলিক অফিস সূত্রে জানা গেছে, আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে চারটি ফেরির মধ্যে গোলাম মওলা ও হামিদুর রহমান নামের দুটি ফেরি চলাচল করছে। রাণীক্ষেত আর কপোতি নামের দুটি ফেরি স্রোতের বিপরীতে চলতে না পারায় আরিচাঘাটে নোঙর করে রাখা হয়েছে। স্রোতের কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটেও ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এ নৌরুটে ১৯টি ফেরি চলাচল করছে। ফেরিগুলো যাতায়াতে এখন আগের তুলনায় অধিক সময় লাগছে।মৌলভীবাজার : জেলার হাকালুকি, কাউয়াদিঘি, হাইল হাওরসহ বিভিন্ন হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে ৭ উপজেলার প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কুলাউড়া ও বড়লেখা পৌর শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে পানি উঠেছে। পানিতে মৌলভীবাজার-বড়লেখা আঞ্চলিক মহাসড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। জেলার বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে সদর উপজেলার খলিলপুর, মনুমুখ, আখাইলকুড়া, কনকপুর, কামালপুর, চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের আংশিক প্লাবিত হয়েছে। কুলাউড়া সদরসহ ভূকশিমইল, ভাটেরা, জয়চ-ী, ব্রাহ্মণবাজার, কাদিপুর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এদিকে জেলার জুড়ী উপজেলায় গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় এ উপজেলার ২৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের অধিকাংশ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জনসাধারণের চলাচলে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে।কুলাউড়া আঞ্চলিক বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ওসমান গনি বলেন, বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কুলাউড়া উপজেলার ইসলামগঞ্জ এবং জুড়ীর নার্সারি ফিডারের বিদ্যুৎ সরবরাহ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যার পানি কমে গেলে বিদ্যুৎ পুনরায় চালু করা হবে।নীলফামারী : সকালে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বিকালে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরবর্তী স্বপন বাঁধ মসজিদপাড়া গ্রামের দেড় শ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব পরিবারের বাড়িঘর হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে গেছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে এলাকার ফসল ও রাস্তাঘাট। এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যার কারণে ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়ন, পূর্বছাতনাই ইউনিয়ন, ঝুনাগাছচাপানী ইউনিয়ন, খালিশা চাপানী ইউনিয়ন, খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের প্রায় ৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।রংপুর : তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত অব্যাহত রয়েছে। রংপুর জেলায় প্রায় ১ হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। পানির ওঠা-নামায় তিস্তা নদীর কিছু এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। অনেকে ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। গঙ্গাচড়া লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চরশংকরদহে অনেকেই ত্রাণের প্রত্যাশায় বসে রয়েছেন। শংকরদহ গ্রামে আবারও ভাঙন শুরু হয়েছে। টিনের চালা, বেড়া, চুলা, গবাদি পশু নৌকায় করে মহিপুর শেখ হাসিনা ব্রিজের আশপাশে উঁচু স্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বাসিন্দারা।নেত্রকোনা : বন্যার পানি বিছানা ছুঁই ছুঁই অবস্থায় চলে আসায় চৌকির ওপর চৌকি দিয়ে দিনানিপাত করছেন নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলাসহ বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর পানিবন্দি মানুষ। পানিতে পড়ে মৃত্যুভয়ে শিশুদের কোলেই রাখতে হচ্ছে দিনভর। কারও কারও কোনো রকম একবেলা খাওয়া হলেও কেউ কেউ চিঁড়া মুড়িতেই সীমাবদ্ধ আছেন। নেই বিদ্যুৎ সরবরাহও। এদিকে কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিও পানিতে ভরে আছে।পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সোমেশ্বরী নদীর কলমাকান্দা শাখার উব্দাখালির পানি বিপৎসীমার ১১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে নতুন করে কংশ নদীর পানি বিপৎসীমার ১১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ডুবে গেছে নেত্রকোনা জেলার ৬ উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়ন। তার মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সীমান্ত উপজেলা কলমাকান্দা।লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে তিস্তা ও ধরলার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া তিস্তা ও ধরলা নদীর অববাহিকায় মাইকিং করে সতর্কতা জারি করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, চরের মানুষ যাতে প্রাণহানির শিকার না হন, বিপদে না পড়েন সেই কারণে মাইকিং করে সতর্ক করা হয়েছে।এদিকে অব্যাহত পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার পাঁচ উপজেলার তিস্তা ধরলার তীরবর্তী ৩০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিস্তার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।কিশোরগঞ্জ : পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কিশোরগঞ্জের ১৫টি গ্রামের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে শনিবার রাত থেকে সাময়িক সময়ের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। এদিকে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং টানা বৃষ্টিতে কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার বিভিন্ন সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি উঠেছে বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাটসহ বিভিন্ন স্থানে। এরই মধ্যে অনেকে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন। গবাদি পশুসহ মালামাল সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন কেউ কেউ।রাজবাড়ী : রাজবাড়ীর পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় রাজবাড়ীর পদ্মা নদীর পানি ২১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে জেলার তিনটি পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী দুই দিনের মধ্যে পদ্মার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করবে।ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মেঘনাসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে প্রায় ৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে নাসিরনগরে প্রায় ৮ হাজার হেক্টর বোনা আমন ফসলি জমি, ১ হাজার হেক্টর পাট খেত ও মৌসুমি শাকসবজি পানির নিচে নিমজ্জিত হয়েছে। একটি ব্রিজ ভেঙে কয়েকটি এলাকার বাসিন্দা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এ ছাড়াও উপজেলার তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিকে পানি চলে আসায় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ।ফরিদপুর : ৪৮ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর পানি গোয়ালন্দ পয়েন্টে ৫৭ সেন্টিমিটার বেড়েছে। ফলে ফরিদপুরের পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, মধুমতী, কুমার ও চন্দনা-বারাসিয়া নদীর পানি বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। ফরিদপুরের চরাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল এলাকা এরই মধ্যে পানির নিচে তলিয়ে গেছে। হঠাৎ পানি ঢুকে পড়ায় চরাঞ্চলের বাদাম, তিল, ধানসহ শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থপ্রতিম সাহা জানান, ফরিদপুরে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। যদিও পদ্মা নদীর পানি বিপৎসীমার ১ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ ও কাজিপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ১২ সেন্টিমিটার এবং কাজিপুর পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে কাজিপুর চরাঞ্চলের ৬টি ইউনিয়নের অধিকাংশ ফসলি জমি ও অনেক বসতভিটা পানিতে তলিয়ে গেছে। সদর উপজেলার কাওয়াকোলা, মেছড়া ও সয়দাবাদ ইউনিয়নের সব ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। কিছু কিছু বাড়িতে এরই মধ্যে পানি প্রবেশ করেছে। এসব এলাকার বসতবাড়ির চারপাশে পানি থাকায় সবাই পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সিরাজগঞ্জ পৌরসভার খোকশাবাড়ী ও মালসাপাড়া কাটাওয়াপদা, চরমিরপুর এলাকার অনেক বসতবাড়িতে পানিতে ওঠায় সবাই ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। এসব পরিবারের মধ্যে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ল্যাট্টিন না থাকায় প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতেও নানা সমস্যা হচ্ছে। অন্যদিকে পানি বাড়ায় বেলকুচি, চৌহালী, এনায়েতপুর, শাহজাদপুরের যমুনার অরক্ষিত অঞ্চলে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। শাহজাদপুরের পাঁচিল ও চৌহালীর বাঘুটিয়া এলাকায় গত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ১৫টি বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়াও শাহজাদপুরের রাওতারা বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এদিকে, অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চলনবিলাঞ্চলেও নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যাকবলিতদের মধ্যে ইতোমধ্যে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট দেখা দিতে শুরু করেছে। যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে তাদের সংকট আরও চরম আকার ধারণ করছে।সাভার (ঢাকা) : সাভারে বন্যার পানিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। চারদিকে থই থই করছে। এ অবস্থায় নৌকা তৈরির হিড়িক পড়ে গেছে। নামাবাজার কাঠপট্টিতে নৌকা বিক্রির ধুম পড়েছে।