:নিউজ ইডিটর :মোঃ লিমন তোকদার।বুধবার,০৫ জানুয়ারী ২০২২,
বিসিএস ক্যাডার না হয়ে ভুয়া বিসিএস ক্যাডার পরিচয়ে প্রতারনা বা জালিয়াতির খবর মাঝে মাঝে গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। কিন্তু প্রকৃত এক সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (প্রশিক্ষণরত) এর বিরুদ্ধে অভিনব জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযুক্তের নাম নিশাত ফারাবী। তিনি ৩৮তম বিসিএসে সহকারী কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়ে বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসনে সংযুক্ত আছেন।
চাকরি জীবনের শুরুতে প্রতারণার অভিযোগের মুখে পড়েছেন শিক্ষানবিশ নারী ম্যাজিস্ট্রেট নিশাত ফারাবী। সরকারি তথ্য সেবা নম্বর ৩৩৩ এর নাম ভাঙিয়ে তিনি অর্থ সংগ্রহ করে তা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এ অভিযোগ এনেছেন খোদ নিজের ব্যাচমেটরা। (অভিযোগের একটি কপি প্রতিদিন বাংলাদেশ এর কাছে সংরক্ষিত রয়েছে) বিষয়টি বিভাগীয় তদন্তের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে তথ্য প্রমাণসহ লিখিত আবেদন দিয়েছেন তারা।
এ ঘটনা প্রকাশ হওয়ায় জনপ্রশাসনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
এই সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের (প্রশিক্ষণরত) নিশাত ফারাবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, কয়েকজন অসহায় শিক্ষার্থীকে সহায়তার নামে তিনি ৩৮তম বিসিএস ব্যাচের কয়েকশ কর্মকর্তার কাছ থেকে গত দুই বছর যাবত অর্থ সংগ্রহ করেছেন। নিজের বিকাশ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সংগ্রহকৃত এই অর্থ সহায়তার কাজে ব্যবহার না করে কুক্ষিগত করেছেন।
নিশাত ফারাবী মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) ছাত্রী ছিলেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেকের কাছ থেকেও তিনি একই কায়দায় অর্থ সংগ্রহ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (প্রশিক্ষণরত) নিশাত ফারাবীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাঁদা উত্তোলন করার অভিযোগ আনেন তার ব্যাচমেটরা। ৩৮তম ব্যাচের পক্ষে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা এসএম আব্রাহাম লিংকন এ লিখিত অভিযোগ দেন।
অভিযোগে বলা হয়, নিশাত ফারাবী ৩৮তম বিসিএস ক্যাডার পরিবার গ্রুপে তার নিজস্ব ফেসবুক আইডি, মোবাইল নম্বর, বিকাশ নম্বর ও সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর ব্যবহার করে বিভিন্ন অজুহাতে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। কখনো অসহায় শিক্ষার্থীদের সাহায্যের কথা বলে আবার কখনো ৩৩৩ নম্বরে সাহায্যপ্রার্থীদের জন্য তহবিল গঠনের কথা বলে তিনি অর্থ সংগ্রহ করতেন। তিনি যে মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে অর্থ সংগ্রহ করেছেন জাতীয় তথ্য বাতায়নে সেই নম্বর তার দাপ্তরিক নম্বর হিসেবে প্রকাশিত। লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়, সার্ভিসের বাইরেও তার পূর্ববর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেকের কাছে নিশাত অর্থ সংগ্রহ করেছেন বলে তারা জানতে পেরেছেন। যা সিভিল সার্ভিসের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করেছে। শুধু মর্যাদা ক্ষুণ্ন নয়, এ ধরনের কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রের জন্য মোটেও নিরাপদ নয় বলে মনে করেন বিসিএস ৩৮ ব্যাচের কর্মকর্তারা। বিষয়টি তদন্তের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর আবেদন জানিয়েছেন তারা। লিখিত অভিযোগের সঙ্গে নিশাতকে টাকা দিয়েছেন এমন বেশকিছু কর্মকর্তার নাম, পদবি, সিলসহ তালিকা সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া ফেসবুকে অর্থ আদায়সহ দোষ স্বীকার করে ব্যাচমেটদের সঙ্গে কথোপকথনের বেশকিছু স্ক্রিনশট জমা দেয়া হয়েছে। অভিযোগে উল্লিখিত যে কয়টি বিকাশ নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে একটি নিশাত ফারাবীর। বাকি দুইটি জনৈক মো. জাকির হোসেন ও ফারিয়া অবনীর নামে বিকাশে নিবন্ধিত। সংযুক্ত তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নিশাত ফারাবী তার বাবার হার্টের বাইপাস সার্জারির কথা বলে ব্যাচমেটদের কাছে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। বিষয়টি ব্যাচমেটরা তার স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারেন নিশাত ফারাবীর বাবার হার্টের কোনো অপারেশনই হয়নি। পরবর্তীতে নিশাত ফারাবীর বাবা পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি ব্যাচমেটদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পদায়নের পর জরুরি খাদ্য সহায়তা নম্বর ৩৩৩তে কল করা ব্যক্তিদের সহায়তার কথা বলে ব্যাচমেটদের কাছ থেকে টাকা তোলেন নিশাত ফারাবী। ফেসবুকে ব্যক্তিগত মেসেজে এক ব্যাচমেটকে তিনি লিখেছেন, ৩৩৩তে কল করে যারা রিলিফ চায় আমরা তাদের জন্য পারসোনালি ফান্ড কালেক্ট করতেছি। গভর্নমেন্ট ফান্ড এনাফ না। অনেকে কল দেয়, অফিসে আসে। আমরা বেশি মানুষকে সহায়তা দেয়ার জন্য পারসোনাল ফান্ড রেইজ করতেছি। আমার দায়িত্ব পড়েছে। ব্যাচমেটরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে, এ ধরনের কোনো ফান্ড সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন দাপ্তরিক বা ব্যক্তিগত ভাবে গঠন করেনি। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে অর্থকষ্টে থাকা শিক্ষার্থীদের সহায়তার কথা বলে সহকর্মীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন নিশাত ফারাবী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্তির পর থেকেই নিশাত ফারাবী বিভিন্ন অজুহাতে প্রথমে অসহায় ছাত্রকে সহায়তার নামে তহবিল সংগ্রহ করে। এছাড়া সরকারি তথ্য ও সেবা নম্বরে (৩৩৩ কোড) দরিদ্র মানুষজন সহায়তা চাচ্ছে উল্লেখ করে তাদের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করেন। ৩৮তম বিসিএসের কর্মকর্তাদের কাছে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক মেসেঞ্জার আইডি (নিশাত ফারাবী অন্তরা) থেকে সম্বলহীন,গরীবদের জন্য ফান্ড কালেকশন করছেন এমন মেসেজ পাঠিয়ে তিনি এই অর্থ সংগ্রহ করেন, যার প্রমাণ প্রতিদিন বাংলাদেশ এর হাতে রয়েছে। যদিও বর্তমান নিশাত ফারাবী অন্তরা আইডিটি তিনি ডিঅ্যাকটিভেটেড করে রেখেছেন।
তিনটি বিকাশ নম্বর 01746320…,01772117…,01629920 ও একটি সোনালি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর 0330101015… ব্যবহার করে নিশাত ফারাবী এই অর্থ নিয়েছেন। যে নম্বরগুলো ব্যবহার করে এই অর্থ নিয়েছেন সেগুলো নিশাত ফারাবীর নামে নিবন্ধনকৃত এবং এখনো তিনি এসব নম্বর ব্যবহার করছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, ৩৮তম বিসিএস কর্মকর্তাদের মধ্যে ঘটনা জানাজানি হলে নিশাত ফারাবী প্রথমে দাবি করেন তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে, তিনি নিজেই প্রতারণার স্বীকার হয়েছেন। অথচ, তার ওই ফেসবুক আইডিতে (নিশাত ফারাবি অন্তরা) তিনি চলমান বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ছবি আপলোড করেছেন। যে বিকাশ নম্বরে তিনি টাকা নিয়েছেন সেটা জাতীয় তথ্য বাতায়নে নিবন্ধনকৃত রয়েছে।
এদিকে অভিযুক্ত নিশাত ফারাবীর বিরুদ্ধে ৩৮তম বিসিএস ব্যাচের পক্ষে রংপুর টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক (সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার) এস এম আব্রাহাম লিংকন সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে ভেটেরিনারি সার্জন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কৃষি সম্প্রসারণ অফিসারসহ অন্তত ৩০ জন ভুক্তভোগী স্বাক্ষর করেছেন।
এ বিষয়ে বিসিএস কর্মকর্তা এস এম আব্রাহাম লিংকন বলেন, ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমি অভিযোগ দিয়েছি। অভিযুক্ত নিশাত ফারাবীর প্রতারণা সত্য হলে এমন কাজ সিভিল সার্ভিসের মর্যাদাই শুধু নষ্ট করবে না, উপরন্তু সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারের উপর মানুষের বিশ্বাস ও ভালবাসা হ্রাস পাবে। এজন্য তিনি ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিএস ৩৮তম ব্যাচের কয়েকজন সদস্য জানান, সম্প্রতি নিশাত ফারাবীর এই ঘটনা জানাজানি হয়। ব্যাচের অর্থদাতারা নিশাত ফারাবী এই টাকা কোথায় ব্যয় করেছেন সেটা জানতে চান। কিন্তু তিনি বিভিন্ন অসংলগ্ন জবাব দেন। একপর্যায়ে সহানুভূতি আদায় করার জন্য নিশাত ফারাবী দুইজনকে বাবা-মা সাজিয়ে কথা বলান। কিন্তু পরে জানা যায়, যাদের তিনি বাবা মা সাজিয়ে কথা বলিয়েছেন তারা তার প্রকৃত বাবা নন। তবে সার্বিক ঘটনার জন্য নিশাত ফারাবী ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলেও জানা গেছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (প্রশিক্ষণরত) নিশাত ফারাবীর ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে শুক্রবার রাতে জানতে চাওয়া হয় সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. ফারুক আহাম্মদের কাছে। তিনি নিশাত ফারাবীর বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন।
ডিসি ফারুক আহাম্মদ বলেন, তিনি (নিশাত ফারাবী) এখন অন্যত্র ট্রেনিংয়ে আছেন। আগামী মাসে (জানুয়ারি) সিরাজগঞ্জে যোগদানের কথা রয়েছে। যেহেতু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। আমরা সেটি তদন্ত করব। তদন্তে সত্যতা পেলে অবশ্যই যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেব।
নিশাত ফারাবীর বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের বিষয়ে শুক্রবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আলী আজমের কাছে জানতে জাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি এখনো আমি জানি না। এর বাইরে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।